কি কি উপায়ে তালাক দেওয়া যায়, কখন তালাক কার্যকর হয়, তালাকের পর স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে চাইলে করনীয় ইত্যাদি —–

১। স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক

স্বামী নিজের ইচ্ছায় যখন খুশি তখন তালাক দিতে পারেন। আমাদের দেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পূর্ন বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের মুসলিম ব্যক্তি যে কোন সময় কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। আইনের কাছে তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়না এবং স্ত্রী,তাকে কেন তালাক দেওয়া হল তা জানতে চাইতে পারেনা। কিন্তু সে তালাক মৌখিক বা লিখিত যে ভাবেই দিক না কেন তখনই তা কার্যকর হবে না। তবে এক্ষেত্রে এখনও অনেকে মনে করেন “এক তালাক,দুই তালাক, তিন তালাক” বা বায়েন তালাক উচ্চারণ করা মাত্র তালাক হয়ে যায়। এ কারণে আমাদের দেশে এখনও এ ধরনের মুখে মুখে তালাক বহুল প্রচলিত। কিন্তু এ ধারণা ভুল৷ স্বামী যেকোন সময় তালাক দিতে পারলেও তাকে আইনগতভাবে নিয়ম মেনেই তালাক দিতে হয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝানো হলো –

উদাহরণ- কাশেমের স্ত্রী হালিমা একদিন সংসারের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় রান্না করতে দেরী হয়ে যায়। কাশেম কাজের ফাঁকে দুপুরে ভাত খেতে বাড়ীতে আসলে হালিমা জানায় ভাত দিতে একটু দেরী হবে,কাশেম এতে রাগ করে তার বাড়ীর লোক ও পাড়া-পড়শীর সামনে তিনবার হালিমাকে “তালাক’ উচ্চারন করে শোনায়৷ এখন প্রশ্ন এটা কি তালাক হবে?

না হবে না৷ কারণ রাগের মাথায় তালাক হয় না৷ তালাক দেবার নির্ধারিত আইনগত পদ্ধতি রয়েছে।

২। স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক:

স্ত্রী নিম্নেবর্ণিত পদ্ধতিতে তালাক দিতে পারেন

(ক) আদালতের মাধ্যমে

(খ) তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে

(গ) খুলার মাধ্যমে

৩। এছাড়া স্বামী-স্ত্রী দুই জনই মুবারতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারেন।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-১৯৬১ অনুযায়ী

ধারা-৭:

(১) কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বা কোন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে ইচ্ছা করলে যে কোন প্রকারেই হোক তালাক উচ্চারণ করবার পরেই সে তালাক দিয়েছে বলে চেয়ারম্যানকে লিখিত নোটিসের মাধ্যমে জানাবে ও স্ত্রীকেও/স্বামীকেও এর এক কপি পাঠাবে।

(২) কোন ব্যক্তি ১ নং উপধারার বিধান লঙ্ঘন করলে সে এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ডে বা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হবে।

(৩) ৫ নং উপধারার বিধান অনুযায়ী অন্য কোনভাবে প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে কোন তালাক পূর্বাহ্নে প্রত্যাহার না করা হলে ১ নং উপধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যানের নিকট প্রেরিত নোটিসের তারিখ হতে ঌ০ দিন অতিরিক্ত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত তালাক কার্যকরী হবে না।

(৪) ১নং উপধারা অনুযায়ী নোটিস প্রাপ্তির ৩০ দিনের ভিতর চেয়ারম্যান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে পুর্নমিলন স্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি সালিশী কাউন্সিল গঠন করবেন ও এই কাউন্সিল পুর্নমিলন ঘটাবার নিমিত্ত সকল প্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

(৫) তালাক প্রদানের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে ৩ উপধারায় বর্ণিত মেয়াদ বা গর্ভকাল- এই দুই-এর মধ্যে যা পরে হবে তা অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকরী হবে না।

(৬) এই ধারা অনুসারে কার্যকরী তালাক মাধ্যমে যে স্ত্রীর বিবাহ ভঙ্গ হয়েছে ,ঐ বিবাহ ভঙ্গ তৃতীয়বারের মতো কার্যকরী না হয়ে থাকলে তৃতীয় ব্যক্তির সাথে মধ্যবর্তীকালীন কোন বিবাহ ব্যতীতই তার আগের স্বামীর সাথে পূনর্বিবাহে কোন প্রকার বাধা থাকবে না।

ধারা-৮:

তালাক ব্যতীত অন্যভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ:

যেক্ষেত্রে তালাক দেওয়ার অধিকার যথাযথভাবে স্ত্রীর নিকট অর্পণ করা হয় ও সে উক্ত অধিকার প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক হয় বা যেক্ষেত্রে একটি বিবাহের পক্ষদ্বয়ের যে কোন একপক্ষ তালাক ব্যতীত অন্যভাবে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে ইচ্ছুক হয় সেইক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে প্রয়োজন অনুযায়ী ৭ ধারার বিধানসমূহ প্রযোজ্য হবে।

অন্যান্য

তালাক কখন কার্যকরী হয় না?

গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে সন্তান ভূমিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকরী হবে না৷ এক্ষেত্রে ৯০ দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার মধ্যে যেদিনটি পরে হবে সেদিন থেকে তালাক কার্যকরী হবে৷ অর্থাত্‍ স্ত্রী গর্ভবতী হলে, সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না৷ মনে রাখতে হবে এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্ত্রী পূর্ণ ভরণপোষণ পেতে আইনত হকদার৷

তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী কি পুনরায় বিয়ে করতে পারবে ?

হাঁ পারে৷ ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ (৬)ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি পুনরায় বিয়ে করতে চাইলে সেক্ষেত্রে নতুন করে বিয়ে করতে হবে।

উদাহরণ: কাশেম তার স্ত্রী হালিমাকে তালাক দিল। তিনমাস পর কাশেম বুঝতে পারল যে, তালাক দেয়াটা তার ভূল হয়েছে এবং সে এখনো হালিমাকে ভালবাসে৷ খবর নিয়ে জানা গেল হালিমাও তার কাছে ফিরে আসতে চায়। এখন তারা যদি আবার একসাথে বসবাস করতে চায় তবে তাদেরকে পুনরায় বিয়ে করতে হবে৷ এখানে বলে রাখা দরকার যে, এক্ষেত্রে হিল্লা বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।১ঌ৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে হিল্লা বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং তালাক হওয়া দম্পতি হিল্লা বিয়ে ছাড়াই পুনরায় বিয়ে করে একসাথে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু পরপর তিনবার তালাক হলে তৃতীয়বার স্ত্রীকে আরেকজনের সাথে বিয়ে দিয়ে তারপর বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রথম স্বামী বিয়ে করতে পারবে।

তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে ?

তালাকের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকবে। এক্ষেত্রে ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়ঃসদ্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে৷ তবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবা বহন করবে৷ যদি বাবা দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সালিসীর মাধ্যমে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন।

তালাক কখন প্রত্যাহার করা যায় ?

৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগেই তালাক প্রত্যাহার করা যায়৷ ঌ০ দিনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এটা মাথায় রেখে যাতে এ সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষ ঠান্ডা মাথায় সব কিছূ ভেবে চিন্তে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে পারে। একটা বিষয় পুনরায় মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, তালাক দেওয়ার নব্বই দিন পর তালাক কার্যকরী হয় কিন্তু এই ঌ০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে যে কোন দিন তালাক প্রত্যাহার করা যাবে।

তালাক রেজিস্ট্রেশন করতে হয় কি না ?

মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে তালাক রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক।

উদাহরণ:জসিম তার স্ত্রী সাবিনাকে তালাক প্রদানের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে দরখাস্ত করে৷ চেয়ারম্যান সালিস ডেকে আলাপ- আলোচনা করে তালাক কার্যকরী করলে জসিম রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়ে তালাকটি অবশ্যই রেজিস্ট্রী করবেন।

মুসলিম বিয়ে ও তালাক ( রেজিস্ট্রেশন ) আইন ১৯৭৪ এর বিধান অনুযায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার মৌখিক আবেদনের ভিত্তিতে তালাক রেজিস্ট্রি করতে পারেন ৷পর্দানশীন মহিলার ক্ষেত্রে তার কর্তৃত্ব প্রাপ্ত কোন ব্যাক্তি তালাকের আবেদন পেশ করতে পারেন৷ স্বামী স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন সে মর্মে কোন দলিল বা দলিলের সত্যায়িত প্রতিলিপি ছাড়া নিকাহ রেজিস্ট্রার তালাক-ই-তৌফিজ হিসেবে পরিচিত কোন তালাক রেজিস্ট্রি করবেন না ৷ নিকাহ রেজিস্ট্রার তালাক রেজিস্ট্রি করতে অস্বীকার করলে উক্ত অস্বীকৃতির ত্রিশ দিনের মধ্যে আবেদনকারী জেলা রেজিস্ট্রারের নিকট আপীল দায়ের করতে পারেন এবং সে ক্ষেত্রে জেলা রেজিস্ট্রারের আদেশ চূড়ান্ত বলে গন্য হবে (ধারা-৬)।

কোন বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হবার পর নিকাহ রেজিস্ট্রার সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে নিকাহনামা বা তালাকনামার সত্যায়িত প্রতিলিপি প্রদান করবেন এবং ঐরূপ সত্যায়িত প্রতিলিপির জন্য কোন ফি আদায় করা যাবে না (ধারা-৯)৷

তালাক রোধে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব:

অনেক সময় দেখা যায়,মানুষ রাগের মাথায় অথবা আবেগের বশবর্তী হয়ে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ পরে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু তখন কি করবে তা বুঝে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে যদি চেয়ারম্যান সালিসীর মাধ্যমে উভয় পক্ষকে ডেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার দ্বারা তাদের মধ্যে পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করে দেন তবে দু’পক্ষেরই ভালো হয়। এজন্য বলা হয় তালাক রোধে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও গুরুত্ব অপরিসীম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

× Chat